মাস তিনেকের মধ্যে ভারতে সাধারণ নির্বাচন। ভোটে লড়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি বিপুল টাকা খরচ করে। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অনেক দলই কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে চাঁদা নেয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই নয়া পদ্ধতি বাতিল হয়ে গিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের 'ধাক্কা'
নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ রায় দিয়েছে, বেনামী নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প সাংবিধানিক অধিকার লংঘন করেছে। সেই কারণে এই ব্যবস্থা অসাংবিধানিক।
এই বেঞ্চে বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বিচারপতি বিআর গাভাই, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপত মনোজ মিশ্র ছিলেন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে। ২ নভেম্বর মামলার রায়দান স্থগিত রেখেছিল শীর্ষ আদালত।
চাঁদা আদায়ের ব্যবস্থা অসাংবিধানিক, এই যুক্তিতেই নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প খারিজ করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আর্থিক অনুদান দিচ্ছে, সেই সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, বেনামী নির্বাচনী বন্ড দেয়া হলে তা তথ্য জানার অধিকার আইন এবং সংবিধানের ১৯ (১-এ) ধারাকে ভঙ্গ করবে। এই ধারায় নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, যে সব ব্যাংক নির্বাচনী বন্ড জারি করে, সেগুলি আর বন্ড জারি করতে পারবে না। ১৩ মার্চের মধ্যে নিজেদের ওয়েবসাইটে নির্বাচন কমিশনকে এসব তথ্য প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন দেশের প্রধান বিচারপতি।
নির্বাচনী বন্ডের কাহিনি
নির্বাচনী বন্ডের ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ২০১৭ সালের অর্থ বিলের মাধ্যমে এই প্রকল্প কার্যকর করা হয়। নির্বাচনকেন্দ্রিক আর্থিক অনুদানের ক্ষেত্রে কালো টাকার লেনদেন হওয়ার অভিযোগ প্রতিনিয়ত ওঠে।
কেন্দ্রের যুক্তি, এই পরিস্থিতি বদলাতে ও স্বচ্ছতা আনতে নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প চালু করা হয়। কোনো দলকে নগদ টাকা দেয়ার বদলে, সেই টাকায় সরকারি ব্যাংক থেকে বন্ড কেনা যায়। এই বন্ড রাজনৈতিক দলকে অনুদান হিসেবে দিতে পারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।
বন্ড যে দলগুলি পাচ্ছে, তারা নিজেদের ব্যাংক খাতায় বন্ড ভাঙিয়ে সমপরিমাণ অর্থ পেতে পারে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকে কারা টাকা দিল, সেটা আড়ালে থেকে যায়। বন্ড প্রাপ্তির নিরিখে সব দলের থেকে এগিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি। এর পরের স্থানে রয়েছে কংগ্রেস। এই দুটি জাতীয় দলের পর তৃতীয় স্থানে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) নামক সংগঠন নির্বাচনী বন্ডের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছিল। এদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষ পর্যন্ত বিজেপি ৬,৫৬৬ কোটির বেশি টাকা বন্ডের মাধ্যমে পাওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
ওই একই সময়ে কংগ্রেস ১,১২৩ কোটির বেশি ও তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ১,০৯৩ কোটি টাকা পেয়েছে বন্ডের মাধ্যমে। এই তথ্যই বলে দিচ্ছে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল। তৃণমূল ছাড়াও এনসিপি, টিডিপি, আম আদমি পার্টি, বিজেডি, ডিএমকে-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দল বন্ড থেকে টাকা নিলেও, বামপন্থী দলগুলি নির্বাচনী বন্ড ব্যবহার করে তহবিল সংগ্রহ করেনি।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে প্রতি অর্থবর্ষের আয়-ব্যয়ের হিসেব পেশ করতে হয় নির্বাচন কমিশনে। সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে তৃণমূল প্রায় ৪১ কোটি টাকা পেয়েছিল নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে তা বেড়ে হয় ৫২৮ কোটির বেশি। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের আয়ের কমবেশি ৯৬ শতাংশই এসেছে বন্ড থেকে।
গণতন্ত্রের বিপদ
কর্পোরেট সংস্থার থেকে চাঁদা নেয়া কোনো দল ক্ষমতায় এলে, সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেবে। এই ধারণা থেকেই এভাবে তহবিল সংগ্রহের পদ্ধতিকে সমালোচনা করা হয়।
তবে বন্ডের ক্ষেত্রে পুরোটাই ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে হস্তান্তরিত হওয়ায় আর্থিক স্বচ্ছতা থাকে বটে, কিন্তু এই 'বন্ধুত্বপূর্ণ পুঁজিবাদ' গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নড়বড়ে করে দেয় বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন।
বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেন, "কর্পোরেট সংস্থাগুলিরাজনৈতিক দলকে টাকা দেবে কেন? যদি টাকা দেয়, তা হলে অবশ্যই দলগুলি ভোটে জিতে এলে তারপর কর্পোরেট সংস্থাগুলি তাদের কাছ থেকে সুবিধা নেবে। এটাকেই বন্ধুত্বপূর্ণ পুঁজিবাদ বলে। এটা একটা দেশে থাকা উচিত কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন।"
বন্ড ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেলেও, আগের উপায়ে কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির কোনো বাধা থাকছে। তা হলে বিজেপি, কংগ্রেস বা তৃণমূলের বন্ড ছাড়া নির্বাচনী খরচ সামলাতে আদৌ কি সমস্যায় পড়ার কথা?
পর্যবেক্ষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বন্ডের মাধ্যমে টাকা না পেলেও খুব একটা অসুবিধা হবে না। আয়ের অন্য উৎস আছে। তবে এই ব্যবস্থা ঠিক নয়। এর মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থায় দুর্নীতিকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।"
এডিআর-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সঞ্চালক উজ্জয়িনী হালিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তার অন্যতম প্রধান উৎস এই বন্ড। সেই টাকা কে দিল, তা নিয়ে জনগণ অন্ধকারে থাকে। তাই বন্ড খারিজকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। তাতে গণতন্ত্রের উপর নেমে আসা এইসব আঘাতের মোকাবিলা করা যাবে।