বিহারের পরে পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় সার্বিক সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করতে চলেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। ভুয়ো ভোটার চিহ্নিত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ। বিরোধীরা এর মধ্যে এনআরসি-র ছায়া দেখছে।
আগামী বছর এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সেদিকে লক্ষ্য রেখে মাস দুয়েকের মধ্যে শুরু হতে চলেছে ভোটার তালিকায় সংশোধনের কাজ, যার নাম স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর।
তালিকা সংশোধন
নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গে দু দশকের বেশি সময় আগে তথ্য যাচাই করে ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য যাচাইয়ের এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা সার্বিক সংশোধন।
২০০২ সালে শেষ বার এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় রাজ্যে ছিল বামফ্রন্ট সরকার। সেই সময়ে প্রায় ২৮ লক্ষ ভুয়ো ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল। কমিশন সূত্রের খবর পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ভোটার তালিকায় বিপুল সংখ্যায় ভুয়ো ভোটার রয়েছে।
সাধারণভাবে প্রতিবছর আড়াই শতাংশের কম ভোটার বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক হলে ধরে নেয়া হয়। সেই হিসেবে ২০০২ সালের পর থেকে ভোটার বৃদ্ধি ৫০% এর নিচে থাকার কথা। কিন্তু এ রাজ্যের ভোটার তালিকায় নির্বাচকের সংখ্যা ৬৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ১৫ শতাংশের ব্যবধান কেন, তার রহস্য ভেদ হতে পারে, সার্বিক সংশোধন অভিযানের মাধ্যমে।
বিভিন্ন কারণে একই ভোটারের নাম একাধিক তালিকায় থেকে যায়। কোন নারীর বিয়ের পর নতুন জায়গায় নাম অন্তর্ভুক্ত করলে এই সমস্যা দেখা যায়। চাকরি-সুত্রে কেউ অন্য জায়গায় বসবাস করলে সেখানে অনেক ক্ষেত্রে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে পুরনো তালিকায় নাম থেকে যায়। এছাড়া যারা প্রয়াত হয়েছেন, তাদের নামও তালিকা থেকে যথাসময়ে বাদ পড়ে না।
গত মাসে নদিয়া জেলার কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়। তার আগে ভোটার তালিকায় সংশোধন অভিযান চালানো হয়েছিল। তাতে আট হাজার ভোটারের নাম বাদ পড়ে। এই কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা দুই লক্ষ ৫২ হাজার। এর মধ্যে ৪ শতাংশ ভোটারের নাম বাদ পড়েছে। বৈধ ভোটার বাদ পড়েছেন বলে রাজনৈতিক দলগুলি কোন অভিযোগ কমিশনের কাছে করেননি।
রাজ্যে রাজ্যে সংশোধন
প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের বিধানসভা নির্বাচন অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। সেখানে চলছে বিশেষ সংশোধন অভিযান। নির্বাচন কমিশন আগামী দিনে গোটা দেশে এই অভিযানে নামবে। সেখানেও ২০০৩ সালকেই সময়সীমা হিসাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
বিহার বিধানসভার পরেই পরপর কয়েকটি জায়গায় নির্বাচন হবে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে অসম, কেরল, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু। এখানেও বিধানসভা ভোটের আগে ভোটার তালিকার সার্বিক সংশোধন অভিযান চালাবে কমিশন। বিহারের প্রক্রিয়া অনুযায়ী, ২০০৩ সালের পরবর্তী সময়ে যাদের নাম ভোটার তালিকায় উঠেছে, তাদের প্রত্যেককেই ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দিলে তবেই নাম উঠবে তালিকায়।
এই প্রক্রিয়াতে ২০০৩ সালের আগে যাদের নাম ভোটার তালিকায় ছিল না, তাদের জন্মস্থানের প্রামাণ্য নথি জমা দিতে হবে। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের পরে যারা জন্মেছেন, তাদের নিজস্ব এবং বাবা-মায়ের নথিপত্র হাজির করতে হবে। বাবা-মা বিদেশি নাগরিক হলে লাগবে তাদের পাসপোর্ট ও ভিসার কপি।
বিরোধীদের প্রতিবাদ
ভোটার তালিকায় সংশোধনের এই অভিযানের ফলে কার্যত নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিলের সমতুল হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে বিরোধীদের দাবি। এ নিয়ে আন্দোলন শুরুর পাশাপাশি আইনি লড়াইয়ের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। সোমবার বিহারের রাজধানী পাটনায় ইন্ডিয়া মঞ্চের নেতারা জানিয়েছেন, বুধবার কমিশনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিহার বনধের ডাক দেওয়া হয়েছে।
স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশনের পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করে বিরোধীরা যৌথভাবে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছে।এর মধ্যে রয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র, কংগ্রেসের কেসি বেণুগোপাল থেকে সিপিআইএমের এর দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সহ বিভিন্ন দলের নেতারা। তাদের বক্তব্য, এই সংশোধন প্রক্রিয়া অবৈধ। এটি ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনকে লঙ্ঘন করছে।
একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও এ নিয়ে মামলা দায়ের করেছে সর্বোচ্চ আদালতে। সকলেই এই সংশোধন অভিযান বাতিল করার আবেদন জানিয়েছে। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ জানিয়েছে, এই সংক্রান্ত শুনানি হবে বৃহস্পতিবার। আদালতে দায়ের হওয়া মামলায় যে সাংবিধানিক ও আইনি প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় সরকারকে নোটিশ জারি করেছে বেঞ্চ।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর) সুপ্রিম কোর্টে এসআইআরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সঞ্চালক উজ্জয়িনী হালিম ডিডাব্লিউকে বলেন, "এসআইআর প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে, দেশের বহু সত্যিকারের নাগরিক তাদের ভোটাধিকার হারাবেন। বর্তমানে বিহারে যা হচ্ছে সেটা নানা দিক থেকেই সমস্যাজনক। রাষ্ট্র বানিয়েছে ভোটার লিস্ট, যা রাষ্ট্র নিয়মিত সংশোধন করে। কিন্তু কোনোভাবেই ভোটারদের ঘাড়ে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় চাপানো যায় না, আর নির্বাচন কমিশনের তো সেরকম এক্তিয়ারই নেই। বিহারে এত কম সময়ের মধ্যে প্রায় আট কোটি মানুষকে ফর্ম ভর্তি করতে বলা হচ্ছে, দিতে বলা হচ্ছে এমন নথি যা আমাদের গ্রামীণ ভারতের বেশির ভাগ মানুষের কাছেই নেই। এছাড়া ভোটার তালিকা থেকে যার নাম বাদ যাবে, তাকে আগে নোটিস দিতে হয়, শুনানি হয়। সেই আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে।"
অনুপ্রবেশ ও সংশোধন
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই সংশোধনের বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। এ রাজ্যে দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে বিজেপির দীর্ঘদিনের অভিযোগ। এর ফলে এ রাজ্যের জনবিন্যাসে পরিবর্তন হচ্ছে। তাদের দাবি, শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদতে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজনকে ভোটার কার্ড তৈরিতে সাহায্য করা হচ্ছে।
সম্প্রতি এমন একাধিক নমুনা সামনে এসেছে। যেখানে দেখা গিয়েছে, কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে বছরের পর বছর বসবাসের পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রশাসনের অংশ হয়ে উঠেছেন। তারা রাজনৈতিক দলের নেতা এমনকি পঞ্চায়েতের প্রধানের পদ পেয়ে গিয়েছেন। কেউ হয়ে উঠেছেন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক।
যেমন, উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী আলোরানি সরকার, মালদার হরিশ্চন্দ্রপুরে একটি পঞ্চায়েতের সাবেক প্রধান লাভলি খাতুনের নাগরিকত্ব নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে। কাকদ্বীপের তৃণমূল নেতা হিসেবে পরিচিত নিউটন দাসের নাম বাদ পড়েছে ভোটার তালিকা থেকে। তিনি গত আগস্টে বাংলাদেশে সরকার বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন বলে তথ্য উঠে এসেছিল। এমনকি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক বাংলাদেশি নাগরিক শান্ত ভৌমিকের এ দেশে ভোটার ও আধার কার্ড তৈরি হয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠেছিল।
সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, "যে বাংলাদেশিরা ভারতে ঢুকে নাগরিকত্বের পরিচয় পত্র পেয়ে গিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ। অতীতে এনআরসির ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, এখন এই সংশোধনের ক্ষেত্রেও সেটা দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেস, তৃণমূল এর বিরোধিতা করছে। যেহেতু এই অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করা বাংলাদেশিরা মূলত তাদের ভোটার। তথাকথিত সেকুলার দলগুলি, এই বাংলাদেশিদের বাঁচানোর চেষ্টা করবে যাতে তাদের ভোট বাড়ে।"
বিজেপির রাজনীতিকে দায়ী করে তিনি বলেন, "বাংলাদেশি ও ভারতীয় মুসলমানদের চিহ্নিত করার কাজটা খুব পরিচ্ছন্নভাবে হয় না। এজন্য আমাদের সহনাগরিক বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়। এনআরসির সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতায় বলেছিলেন, হিন্দুদের কোনও ভয় নেই। তার মানে কি ভারতীয় মুসলমানদের ভয় আছে? এই যে সাম্প্রদায়িক তাসটা বিজেপি সারাক্ষণ খেলে, তার ফলে পরিস্থিতির অবনতি হয়। তার বলা উচিত ছিল, ভারতীয়দের কোন ভয় নেই। সাম্প্রদায়িক মনোভাব সমস্যার কারণ হয়।"
তার মতে, "এছাড়া নির্বাচন কমিশন যাদের দিয়ে এ কাজ করাবে, তাদের মধ্যেও একটা সাম্প্রদায়িক ঝোঁক থেকে যায়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ক্ষেত্রেও এই কথাটা সত্যি। এর সঙ্গে ঘুষ নিয়ে তথ্য বিকৃতির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে কাজটা স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করাটা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজা গোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মী নেই দপ্তরের বাইরে। ফলে এই কাজ রাজ্য সরকারের কর্মীদের দিয়েই তাদের করাতে হবে। যদি স্বচ্ছ ভাবে সংশোধনের কাজ করা যায় তাহলে কোন দলেরই আপত্তি থাকার কথা নয়। যারা অন্য দেশ থেকে এসে এখানে বসবাস করছে, ভোট দিচ্ছে, তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ যাওয়াই উচিত।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "এর ফলে যারা মৃত ও অন্য ঠিকানায় চলে গিয়েছেন, তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া যেতে পারে। এর বেশি কিছু করা যাবে না। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন একটা তালিকার ভিত্তিতে হয়েছে। তার পরে এখন সংশোধন করে কী লাভ হবে? এর অনেক আগে ২০০২-০৩ সালে ফিরে যাচ্ছে কমিশন। তার উপরে আধার বা প্যান কার্ড প্রমাণ হিসেবে বিবেচ্য নয়। যদি নতুন নাম তালিকায় যুক্ত হয় আর সে সম্পর্কে অভিযোগ থাকে, তাহলে বুথ স্তরে বিষয়টা তদন্ত করে দেখা যেতে পারে। সেজন্য আবার একটা পেপার ওয়ার্ক আমলাতন্ত্রের উপরে চাপিয়ে দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? অফিসাররা যাদের বাড়িতে যাবেন, তারা সবাই উপস্থিত থাকবেন এমনটাও কথা নয়। এক শতাংশ যদি ভুয়ো ভোটার থাকে, তাহলে একশ শতাংশ মানুষকে ফর্ম ফিলাপ করানো একপ্রকার হেনস্থা। সবথেকে গরিব মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিকরা যাতে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন, সে জন্য এটা করা হচ্ছে।"