Skip to main content
Source
NAGORIK.NET
https://nagorik.net/politics/loksabha-elections-2024/electoral-bond-turns-black-money-into-white/
Author
ডিজিটাল ডেস্ক
Date

এখন ট্রেন-বাস থেকে চায়ের ঠেক – সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রে নির্বাচনী বন্ড। সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের ফলে জনসাধারণ জানতে পারল রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের বিপুল বিলাসিতা, আড়ম্বরের উৎস। প্রকাশ্যে এল নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য, যা নির্বাচনী গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র অর্থাৎ সমতা, সমানাধিকার, সকলের তথ্য জানার অধিকারকেই খর্ব করে।

২০১৭ সালে নির্বাচনী বন্ডের সূচনা করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ তারিখের কেন্দ্রীয় বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছিলেন ‘স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও, দেশ রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদান দেবার একটিও স্বচ্ছ পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারেনি, যা অবাধ ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থার জন্য অত্যাবশ্যক’। দাবি করা হয়েছিল, রাজনৈতিক অনুদানের ক্ষেত্রে নির্বাচনী বন্ড অধিকতর স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে ঠিক তার বিপরীত। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে চাঁদা দেওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু দাতাদের নাম জনসমক্ষে আসবে না, তাই বেনামে চাঁদা দেওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জন্মলগ্ন থেকেই বন্ডকে ঘিরে স্তরে স্তরে দুর্নীতি ঘনিয়েছে, যার সাথে যুক্ত রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে কর্পোরেট জগতের ছোট বড় অনেকেই। মোটামুটি সবাই জানে, বিভিন্ন কোম্পানি বা কর্পোরেট এজেন্সি রাজনৈতিক দলগুলিকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে থাকে। কিন্তু সেই সাহায্যকে সরকারী সিলমোহর দিয়ে বেনামী সাহায্যে পরিণত করে দুর্নীতির এক নতুন দিগন্ত খুলেছে নির্বাচনী বন্ড। আর এই অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে গণতন্ত্রের মূলেই কুঠারাঘাত করতে উদ্যত হয়েছে।

নির্বাচনী বন্ড জিনিসটা কী? এ আসলে এক ধরনের আর্থিক প্রতিশ্রুতি পত্র যা ‘বেয়ারার’ বা বাহকী বন্ড। অর্থাৎ এতে ক্রেতা বা প্রদানকারী, কারোর নাম থাকে না। মালিকানার কোনো তথ্য রেকর্ড করা হয় না এবং যার হাতে (অর্থাৎ রাজনৈতিক দল) এই বন্ড থাকবে সে-ই এর মালিক। সহজ কথায়, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যম যে কেউ রাজনৈতিক দলকে অর্থ দিতে পারে। শুধুমাত্র স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অনুমোদিত শাখাগুলি থেকে এই বন্ড কেনা যায়। এই হিসাবে একজন দাতা যে কোনো মূল্যের বন্ড কেনার জন্য একটি চেক বা কোন ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে (নগদ অনুমোদিত নয়) অনুমোদিত এসবিআই শাখায় পছন্দের রাজনৈতিক দলের নামে টাকা জমা করবে। বন্ড জমা হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলিকে এই ধরনের বন্ড এনক্যাশ করতে হবে, অর্থাৎ ভাঙিয়ে নিতে হবে। অবশ্যই এই প্রক্রিয়াটি বেনামী। অর্থাৎ এতে দাতার নামোল্লেখ থাকবে না। কোনো ব্যক্তি বা কর্পোরেট এককভাবে বা অন্য কারোর সঙ্গে যৌথভাবে বন্ড কিনতে পারে। সরকার ঘোষণার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বন্ড বিক্রি করে। নির্বাচনী বন্ড কেনার কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা কর্পোরেট যত খুশি বন্ড কিনে পছন্দের রাজনৈতিক দলকে অর্থের জোগান দিতে পারে। পনেরো দিনের মধ্যে বন্ডের টাকা না তুললে সেই টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা হয়ে যাবে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) নামক এক সর্বভারতীয় সামাজিক সংস্থা ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখে এই নির্বাচনী বন্ডের ত্রুটিগুলি উল্লেখ করে, এই ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। পরে ২৪ জানুয়ারি, ২০১৮ তারিখে সিপিএম এবং ৫ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে জয়া ঠাকুর বন্ডের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন। এই মামলার শুনানি যথেষ্ট ঢিমেতালে শুরু হয়। এক মধ্যবর্তী রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্দেশ দেয় যে এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত পাওয়া নির্বাচনী বন্ডের তথ্য বন্ধ খামে নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। এরপরেও মাত্র কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল ছাড়া, সেই তথ্য কোনো বড় দল নির্বাচন কমিশনকে জানায়নি। এরপর আসে সুপ্রিম কোর্টের বহু প্রতীক্ষিত রায়। গত ১২ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ডকে অসংবিধানিক ঘোষণা করে এবং এই বন্ড সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়। এই বন্ডে দাতার নাম গোপন থাকায় নির্বাচনী বন্ড নাগরিকের তথ্য জানার মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে বলে জানায় আদালত।

এর পাশাপাশি আদালত স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে আদেশ দেয়, এই বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য নির্বাচন কমিশনকে দিতে। নির্বাচন কমিশনকে বলা হয়, সেই তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। সেই আদেশের পরেও স্টেট ব্যাঙ্ক নির্বাচনী তথ্য প্রকাশ করতে অনীহা দেখায়। ব্যাঙ্ক তথ্য দিতে দেরি করায় এডিআর আবার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে, আদালত স্টেট ব্যাঙ্ককে বিশেষভাবে সব তথ্য প্রকাশ করার আদেশ দেয়, অন্যথায় তা আদালত অবমাননা বলে গণ্য হবে বলে জানায়। তা সত্ত্বেও স্টেট ব্যাঙ্ক এখন পর্যন্ত আংশিক তথ্যই প্রকাশ করেছে। তাদের প্রকাশিত তথ্যে বন্ড কারা কিনেছে এবং কারা ভাঙিয়েছে তা জানা যাচ্ছে, কিন্তু বিশেষ আলফানিউমেরিক নম্বর, যা প্রতিটি বন্ডে থাকে এবং যা দিয়ে কে কাকে কত টাকা দিল তার সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়, তা ব্যাঙ্ক এখন প্রকাশ করেনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা আজ প্রকাশ করার কথা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কর্পোরেটদের পক্ষ থেকে কয়েকটি গোষ্ঠী শেষ মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে আর্জি জানিয়েছিল, কর্পোরেটদের নাম যেন জনসমক্ষে না আসে। আদালত পত্রপাঠ তা খারিজ করে।

এই প্রেক্ষাপটে আজ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের আলোকে যদি নির্বাচনী বন্ডের বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে যে চিত্রটি সামনে আসে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একদিকে দেখা যাচ্ছে এই বন্ডের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে কেন্দ্রের শাসক দল প্রচুর অনুদান পেয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে নির্বাচনে সকলের জন্য সমান সুযোগের যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাকে নস্যাৎ করেছে। অন্যদিকে যেভাবে বিভিন্ন কর্পোরেট অনুদান দিয়েছে তাকে ঘিরেও উঠছে অনেক প্রশ্ন। এক টাকা মুনাফা নেই এমন কোম্পানি কোটি কোটি টাকার বন্ড কিনে রাজনৈতিক অনুদান দিয়েছে। বড় অঙ্কের অনুদানের আগে বা পরে কর্পোরেট বড় মাপের কন্ট্র্যাক্ট/টেন্ডার পেয়েছে বা ইডি, সিবিআই হানা/অনুসন্ধানের পরেই অনেক কর্পোরেট বড় অঙ্কের বন্ড কিনেছে। এই সব খণ্ড চিত্র এক পূর্ণাঙ্গ দুর্নীতির চিত্রকেই স্পষ্ট করে তুলেছে।

১২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে স্টেট ব্যাঙ্ক নির্বাচনী বন্ডের যে তথ্য জনসমক্ষে আনে তাতে দেখা যায় ১২ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলি ২০,৪২১টি নির্বাচনী বন্ড সংগ্রহ করে। তার মোট মূল্য ১২,৭৬৯,০৮,৯৩,০০০ টাকা (প্রায় বারো লক্ষ সাতশো ঊনসত্তর হাজার কোটি টাকা)। যেটুকু তথ্য সামনে এসেছে তাতে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি টাকা পাওয়া প্রথম পাঁচটি রাজনৈতিক দল হল – বিজেপি (৮৬৩৩ টি বন্ডের মাধ্যমে ৬০,৬০,৫১,১১,০০০ টাকা), তৃণমূল কংগ্রেস (৩৩০৫টি বন্ড থেকে পেয়েছে ১৬,০৯,৫৩,১৪,০০০ টাকা), কংগ্রেস (৩১৪৬টি বন্ড থেকে ১৪,২১,৮৬,৫৫,০০০ টাকা), ভারত রাষ্ট্র সমিতি (১৮০৬টি বন্ড থেকে ১২,১৪,৭০,৯৯,০০০ টাকা), বিজু জনতা দল (৮৬১টি বন্ডের মাধ্যমে ৭,৭৫,৫০,০০,০০০ টাকা)।

বন্ড পার্টি

আগেই বলেছি কোন কোম্পানি কত টাকা কোন রাজনৈতিক দলকে দিয়েছে সেই তথ্য এখনো স্টেট ব্যাঙ্ক দেয়নি। কেন এই লুকোছাপা? ব্যাঙ্কের তথ্য না দেওয়ার এই অনীহা বুঝিয়ে দেয়, সব তথ্য জনসমক্ষে এলে বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী অস্বস্তিতে পড়বে।

একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন, নির্বাচনী বন্ডে দাতা চেকের মাধ্যমে বন্ড কিনে আয়করে ছাড় পায়, যা রাজনৈতিক দল এবং দাতার ব্যালান্স শিটে দেখা যায়। এখানে লুকোছাপার কিছু নেই।

এই দাবি আংশিক সত্য। যদিও বন্ডের কেনাকাটা ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই হয়েছে, কিন্তু সব ক্ষেত্রেই দাতার নাম রয়ে গেছে অন্ধকারে। এমনকি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার বা আমজনতা থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক দল, কারোর কাছেই স্বচ্ছভাবে এই অনুদানের তথ্য থাকার উপায় ছিল না। অন্যদিকে একাধিক খবরে প্রকাশ, ক্ষমতায় থাকা দল স্টেট ব্যাঙ্কের কাছ থেকে সহজেই পেয়েছে বন্ডের পূর্ণাঙ্গ চিত্র। এতে ক্ষমতার অপব্যবহারের সম্ভাবনা যে বৃদ্ধি পায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচনী বন্ডের যতটুকু তথ্য সামনে এসেছে এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আরও যত তথ্য সামনে আসবে, তাতে পরিষ্কার যে নির্বাচনী বন্ড হল ক্ষমতার জোরে পরিকল্পিত দুর্নীতি।

নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সব থেকে বেশি অনুদান পাওয়া দল বিজেপি প্রচার করছে, যেহেতু তারা বড় দল, তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা বন্ডের মাধ্যমে বেশি টাকা পেয়েছে। এখানে স্পষ্ট করা দরকার, নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পে রাজনৈতিক দলের আকার, প্রকার বা লোকসভা, বিধানসভায় তাদের আনুপাতিক উপস্থিতির ভিত্তিতে বন্ড কেনার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। যে কোনো রাজনৈতিক দলকেই যে কেউ অনুদান দিতে পারত। হয়েছেও তাই। অধিকাংশ বন্ডই (৯৬.৯১%) কিনেছে কর্পোরেট। মাত্র ৩.০৯% বন্ড কিনেছে ধনী ব্যক্তিরা।

বন্ড দাতা
ব্যক্তি দাতা

এক দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক আবহ গঠনের পূর্বশর্ত স্বচ্ছ রাজনৈতিক অনুদান এবং সচেতন জনগণ। সঙ্গে অবশ্যই দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনীতিতে পেশীশক্তি ও অর্থবলের প্রভাব তথা কর্পোরেট ও রাজনৈতিক দলের নানাবিধ আঁতাত কমাতে দরকার এক স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যার শুরু সকলের তথ্য জানার মৌলিক অধিকারের মধ্য দিয়ে। নির্বাচনী বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় নিঃসন্দেহে দেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রের শিকড় শক্ত করল।

নিবন্ধকার ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকশন ওয়াচ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত